তৃতীয় একক:-বর্ষামঙ্গল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 Tripura University

3rd Semester Bengali 

বর্ষামঙ্গল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর   জোড়াসাঁকো ১৭ বৈশাখ,​​ ১৩০৪

 

ঐ আসে ঐ  অতি ভৈরব  হরষে

জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে

​​ ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা

​​ শ্যামগম্ভীর সরসা।

গুরুগর্জনে নীল অরণ্য শিহরে,

উতলা কলাপী কেকাকলরবে বিহরে।

​​ নিখিলচিত্তহরষা

ঘনগৌরবে আসিছে মত্ত বরষা।

 

কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিকললনা,

জনপদবধূ তড়িৎচকিতনয়না,

​​ মালতীমালিনী কোথা প্রিয়পরিচারিকা,

​​ কোথা তোরা অভিসারিকা!

ঘনবনতলে এসো ঘননীলবসনা,

ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণরশনা,

​​ আনো বীণা মনোহারিকা।

​​ কোথা বিরহিণী,​​ কোথা তোরা অভিসারিকা!

 

আনো মৃদঙ্গ,​​ মুরজ,​​ মুরলী মধুরা,

বাজাও শঙ্খ,​​ হুলুরব করো বধূরা--

​​ এসেছে বরষা,​​ ওগো নব-অনুরাগিণী,

​​ ওগো প্রিয়সুখভাগিনী!

কুঞ্জকুটিরে,​​ অয়ি ভাবাকুললোচনা,

ভূর্জপাতায় নব গীত করো রচনা

​​ মেঘমল্লার-রাগিণী।

​​ এসেছে বরষা,​​ ওগো নব-অনুরাগিণী!

 

কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,

ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী,

​​ কদম্বরেণু বিছাইয়া দাও শয়নে,

​​ অঞ্জন আঁকো নয়নে।

তালে তালে দুটি কঙ্কণ কনকনিয়া

ভবনশিখীরে নাচাও গনিয়া গনিয়া

​​ স্মিতবিকশিত বয়নে,

কদম্বরেণু বিছাইয়া ফুলশয়নে।

 

স্নিগ্ধসজল মেঘকজ্জল দিবসে

বিবশ প্রহর অচল অলস আবেশে,

​​ শশীতারাহীনা অন্ধতামসী যামিনী--

​​ কোথা তোরা পুরকামিনী!

আজিকে দুয়ার রুদ্ধ ভবনে ভবনে,

জনহীন পথ কাঁদিছে ক্ষুব্ধ পবনে,

​​ চমকে দীপ্ত দামিনী--

​​ শূন্যশয়নে কোথা জাগে পুরকামিনী!

 

যূথীপরিমল আসিছে সজল সমীরে,

ডাকিছে দাদুরী তমালকুঞ্জতিমিরে,

​​ জাগো সহচরী,​​ আজিকার নিশি ভুলো না--

​​ নীপশাখে বাঁধো ঝুলনা।

কুসুমপরাগ ঝরিবে ঝলকে ঝলকে,

অধরে অধরে মিলন অলকে অলকে--

​​ কোথা পুলকের তুলনা।

নীপশাখে সখী ফুলডোরে বাঁধো ঝুলনা।

 

এসেছে বরষা,​​ এসেছে নবীনা বরষা,

গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা--

​​ দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,

​​ গীতিময় তরুলতিকা।

শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে

ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে

​​ শতেক যুগের গীতিকা--

​​ শতশতগীতমুখরিত বনবীথিকা।

------------***-----------

নিসর্গ মহিমার অপরূপ সৌন্দর্যের কবিতা ‘বর্ষামঙ্গল’ । কবিতাটি কবি জোড়াসাঁকোতে বসে লেখেন ১৭ই বৈশাখ, বৃহস্পতিবার ১৩০৪ বঙ্গাব্দে। ইংরেজি ৯ এপ্রিল ১৮৯৭ । ‘ভারতী' পত্রিকার আষাঢ় ১৩০৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নামেই স্পষ্ট যে এর বিষয় বর্ষা। ‘কল্পনা;’র অনেকগুলি কবিতায় ঋতুর বর্ণনা আছে । তবে কবির প্রিয় ঋতু বর্ষা ও বসন্ত। ‘বর্ষামঙ্গল' - এ বর্ষার আবাহন করা হয়েছে। এ কবিতা রচনার কারণ খুঁজলে মনে হতে পারে যে সেদিন আসন্ন কালবৈশাখীর সজ্জিত রূপ দেখে কবিচিত্তে প্রাচীন ভারত জেগে ওঠে । কালিদাস - বানভট্ট - জয়দেব কবিকে হয়তো অনুপ্রাণীত করে থাকবেন । তার গন্ধ আমরা কবিতাতে পাই । মেঘদূত, ঋতুসংহার, কাদম্বরী, গীতগোবিন্দের সুর মাঝেমাঝেই শোনা যায় ৫৬টি ছত্রে এবং ৮টি স্তবকে সম্পন্ন এ কবিতায় ।

প্রথম স্তবকের শুরুতেই বর্ষাকে স্বাগত জানানো হয়েছে।

ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে

 জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভর ভসে

ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা

শ্যামগম্ভীর সরসা।”

ভৈরবের রূপে সে আসছে কিন্তু তার ভয়ঙ্কর মূর্তি বৈশাখের মতো নেই আর। পৃথিবীর মৃত্তিকার বুকে জলসঞ্চন করে সোঁদা গন্ধ জাগিয়ে সে আসছে । সে নবযৌবনা’ এবং ‘শ্যামগম্ভীর'। তবে তার এই গাম্ভীর্যের মধ্যে আছে সরসতা। এমন বাদল দিনে প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তারও বর্ণনা দিয়েছেন কবি । মেঘের ‘গুরুগর্জণে’ নীল অরণ্য শিহরিত হয়েছে। উতলা হবে কলাপী অর্থাৎ ময়ূর তার পুচ্ছ মেলে দিয়েছে।

গুরুগর্জনে নীল অরণ্য শিহরে,

উতলা কলাপী কেকাকলরবে বিহরে।”

শুধু প্রকৃতি জগতেই নয়, বর্ষার আগমনে মানব মনে হিন্দোল জেগেছে । ‘মেঘদূত’ এর পূর্বমেঘের অভিসারিকা রমনীদের কথা মনে পড়ে যায় এ বর্ণনা শুনে –

পথিক জন বধূনাং তদ্‌বিয়োগাকুলানাম ।।”

এবার কবি সরাসরি ‘ঋতুসংহার’ - এর অভিসারিকাদের প্রসঙ্গ আনেন ৷ তাদেরও এ কাব্যের সঙ্গি করে নেন । ‘ঋতুসংহার' এ অভিসারিকার বিদ্যুতের আলোয় দেখে দেখে পথ চলার কথা আছে –

তড়িৎ প্রভাদর্শিতমার্গভূময়ঃ প্রয়ান্তি রাগাদ্ অভিসারিকাঃ

স্ত্রিয়ঃ।”

বর্ষাভিসারে অভিসারিকা প্রিয় মিলনের উদ্দেশ্যে সংকেত কুঞ্জে আসে । রাধা-কৃষ্ণের লীলায় অভিসার যাত্রার ব্যাকুলতা ফুটে উঠেছে বারে বারে । নীল বসনা রাধা। আকাশে মেঘের নীলিমা মন উচাটন। জ্ঞানদাস বর্ণনা করেন-

চলে নীল শাড়ি          নিঙাড়ি নিঙাড়ি

পরাণ সহিত মোর।”

রবীন্দ্রনাথ এ কবিতায় বলেন -

ঘনবন তলে এসো ঘননীলবসনা।”

এরপর শকুন্তলার নব অনুরাগের চিত্রের প্রসঙ্গ আনেন কবি । এরই সূত্রে গীতগোবিন্দের রাধাকৃষ্ণলীলার একটা রূপ মূৰ্চ্ছনার চিত্রের প্রতিফলন দেখা যায় এখানে। মৃদঙ্গ, মুরজ, মুরলী, শঙ্খ, হুলুধ্বনি, কুঞ্জকুটিরে আগমন ইত্যাদি অনুসঙ্গ ঐ গীতগোবিন্দের প্রসঙ্গকে জানিয়ে দেয়৷ কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশী' তে আছে ভূর্জপাতায় নবগীত রচনার কথা ; পদ্মপাত্রে পত্রলিখন প্রসঙ্গ আছে শকুন্তলায় ।

আসলে কবিতাটি বর্ষাবন্দনা । কিন্তু সেই বর্ষাকে নিয়ে কবি ঘুরে বেড়ান প্রাচীন সাহিত্যের জগৎ । তাই এবার তিনি বলেন নববর্ষা এসেছে হে অভিসারিকাগণ তোমরা দেহশোভাকে বর্ধিত করো। তনুশ্রী হয়ে উঠতে বলেন তাই কবি -

“কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,

ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি, লয়ে পরো করবী,

কদম্বরেণু বিছাইয়া দাও শয়নে,

অঞ্জন আঁকো নয়নে।”

অভিসারিকা নায়িকা তার মনের আনন্দ প্রকাশ করে হাতের কঙ্কন বাজিয়ে পালিত শিখী (ময়ূর) নৃত্য করিয়ে। ময়ূরের এই নৃত্যের কথা ‘ঋতুসংহার’ এ আছে। মেঘদূতের উত্তর মেঘ - এ ময়ূরকে নৃত্য করাতে গিয়ে নারীর হাতের বালার - অনরণনের কথা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর কত ‘মেঘদত’ এই অনবাদে উঠে এসেছে এভাবে -

তাহারে নাচায় প্রিয়া            করতালি দিয়া দিয়া,

রণ রণ বাজে তায় বালা ।”

অভিসারের প্রস্তুতি শেষে পথে বেরিয়ে আসে অভিসারিকা। দেখে সে ঘরে ঘরে দুয়ার রুদ্ধ । জনহীন পথ যেন ক্ষুব্ধ বাতাসে কেঁদে ফিরছে । কোন গৃহে একা বিনিদ্র পুরকামিনী শুয়ে রয়েছে । যুথী পুষ্পের সৌরভ সজল সমীরে মিশে ছড়িয়ে পড়েছে। দাদুরী অবিরাম ডেকে যাচ্ছে। এমন নিশি কি ভোলা যায় ।

অভিসারের চরম সার্থকতা মিলনে। বর্ষার সে মিলন শেষ হয় ঝুলনের মধ্যে দিয়ে। তাই কবি বলে -

নীপাশাখে সখী ফুলডোরে বাঁধো ঝুলনা।”

কালিদাসের কাব্যে বর্ষা বিরহের প্রতীক হয়ে উঠে এসেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ‘বর্ষামঙ্গল’-এ বর্ষাকে মিলনের আনন্দের মাত্রায় ধরেছেন, কবি বলেন শত শত যুগ আগে থেকে অসংখ্য কবি বর্ষা প্রকৃতিতে মানব-মানবীর মিলনের অনুভূতিকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন। তার সৌরভ বর্ষার মতোই সৌরভময়।

শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে

ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে

শতেক যুগের গীতিকা

শত শত গীত মুখরিত বনবীথিকা ।”

বর্ষামঙ্গল’এ কবি এঁকেছেন মানব-মানবীর চিরন্তন মিলনের চিত্র, বর্ষার আগমনের অনুষঙ্গে । এবং তা হয়ে উঠেছে এক অনন্য সৃষ্টি । রবীন্দ্র বিশেষঞ্জ নীহাররঞ্জন রায় যথার্থই বলেছেন -

ইহার ধ্বনি ও ছেদ, পদ-বিন্যাসে, শব্দে-চয়নে ও চিত্র-গরিমায় মত্ত নববর্ষার যে সুগভির রূপ ফুটিয়ে উঠিয়াছে তাহার পরিচয় ইহার শব্দার্থের মধ্যে পাওয়া যায় না, যে মোহ - মাধুর্য ইহাকে আশ্রয় করিয়াছে তার সৃষ্টি হইয়াছে অতীত - ভারতের বর্ষা - বিজড়িত স্মৃতি- ঐতিহ্য হইতে, তাহার উপাদান জোগাইয়াছে শতেক - যুগের কবি; ঘনবর্ষার ধারায় যে গীত ধ্বনিত হয় তাহা ত এই কবিদের গীত -

[রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভুমিকা]

 

 

 

  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Cripps mission

Under "Earnsite Batches," Tripura University Syllabus

3rd Semester Foundation Syllabus