Cripps mission

 

ক্রিপস মিশন কি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে 1941 সালে জাপান অতর্কিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ করে । ফলস্বরূপ মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলি প্রবল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় । ইংল্যান্ডের উপনিবেশ হিসেবে ভারতেও জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে । এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য লাভের প্রত্যাশা করে এবং ভারতে এক দৌত্য প্রেরণ করে , যা ক্রিপস মিশন  (Cripps Mission) নামে পরিচিত।

ক্রিপস মিশনের পটভূমি

ভারতে ক্রিপস মিশন প্রেরণের পটভূমি ছিল নিম্নরূপ।

(১) অক্ষশক্তির পক্ষে জাপানের যোগদান

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর জাপান অক্ষশক্তির পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ -এ যুদ্ধে যোগদান করলে যুদ্ধের পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।

(২) জাপানি আক্রমণের মোকাবিলা

ভারতের ওপর জাপানি আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয়। শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার জন্য ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তখন অতি শোচনীয়। অথচ এশিয় রণাঙ্গনে জাপানি আক্রমণের ফলে উদ্ভূত সমস্যাবলী মোকাবিলা করতে গেলে ভারতের শক্তি ও সম্পদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

(৩) কংগ্রেসের সমর্থন

এতদিন ব্রিটিশ সরকারের ধারণা ছিল যে, কংগ্রেস ও হিন্দুদের বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মুসলিম লীগ -এর সাহায্যেই তাদের স্বার্থসিদ্ধি হবে, কিন্তু জাপানি আক্রমণের ভীতি অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। তারা উপলব্ধি করে যে, মুসলিম তোষণ করে লাভ নেই, বরং কংগ্রেস ও হিন্দু সমর্থন লাভই বেশি প্রয়োজন।

(৪) ব্রিটিশ মিত্রের ধারণা

এই সময় ব্রিটেনের মিত্রদের মধ্যেও এই ধারণা প্রবল হয় যে, নিজ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই ব্রিটেন ভারতীয় সমস্যা সমাধানে আগ্রহী নয়।

(৫) চিয়াং কাইশেকের ভারত আগমন

যুদ্ধে ভারতবাসীর সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে চীন -এর রাষ্ট্রপতি চিয়াং-কাই-শেক ভারতে আসেন। গান্ধীজি ও নেহরুর সঙ্গে তাঁর সৌহার্দপূর্ণ আলোচনা হয়।

(৬) আমেরিকার হস্তক্ষেপ

ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল চিয়াং-কাই-শেক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট কে জানান যে, ব্রিটেনের মনোভাবের পরিবর্তন না হলে ভারতের কাছ থেকে সাহায্যের কোন আশা নেই।

(৭) আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষর

১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ও ইংল্যান্ড -এর প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের মধ্যে বিখ্যাত আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষরিত হয় এবং তাতে বিশ্বের সকল জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বলা হয়।

(৮) রুজভেল্টের ঘোষণা

চিয়াং-কাই-শেকের আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৯৪২-এর ২২শে ফেব্রুয়ারি রুজভেল্ট ঘোষণা করেন যে ‘আটলান্টিক সনদের’ বক্তব্য পৃথিবীর সব অঞ্চলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল-এর কাছে অবিলম্বে ভারতীয় সমস্যা সমাধানের দাবি জানান।

(৯) ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের চাপ

এই সময় কিছু ব্রিটিশ রাজনীতিবিদও ভারতকে স্বশাসন দেবার জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকেন। ৮ই মার্চ রেঙ্গুনের পতন হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি কঠিনতর রূপ ধারণ করে।


চার্চিলের ক্রিপস মিশন প্রেরণের ঘোষণা

১১ই মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল যুদ্ধে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ ও ভারতের সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবাবলী নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার উপ-প্রধানমন্ত্রী, তীক্ষ্ণধী আইনজ্ঞ ও বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে অবিলম্বে ভারতে পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন।

ক্রিপস মিশনের লক্ষ্য

  • (১) কোন সদিচ্ছা নয় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ওপর রুজভেল্টের চাপের ফলেই ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমঝোতার জন্য ক্রিপসকে ভারতে পাঠানো হয়।
  • (২) বড়লাট লিনলিথগো-কে লেখা চার্চিল ও ভারতসচিব আমেরির চিঠিতে এর পরিচয় পাওয়া যায়। চার্চিল লিখেছেন—“আমাদের সততা প্রমাণের জন্যই ক্রিপ্‌স্ মিশন অপরিহার্য।… ভারতীয় নেতারা যদি এই প্রস্তাব বাতিল করে দেন তাহলে বিশ্বের কাছে আমাদের আন্তরিকতা প্রমাণিত হবে।
২৩শে মার্চ ক্রিপ‌স দিল্লীতে পৌঁছান। এক সপ্তাহ বিভিন্ন স্তরের ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার পর ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সামনে তিনি একটি প্রস্তাব রাখেন (২৯শে মার্চ, ১৯৪২ খ্রিঃ)। এই প্রস্তাব ‘ক্রিস্‌ প্রস্তাব’ নামে খ্যাত।


ক্রিপস মিশনের প্রস্তাবসমূহ

ক্রিপসের প্রস্তাবে বলা হয় যে,

  • (১) যুদ্ধান্তে ভারতকে ‘ডোমিনিয়নের’ মর্যাদা দেওয়া হবে।
  • (২) যুদ্ধান্তে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সংবিধান সভা গড়া হবে এবং এই সভা নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করবে।
  • (৩) ভারতের কোন প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য ঐ শাসন গ্রহণে অস্বীকৃত হলে, সেই প্রদেশ বা দেশীয় রাজ্য নিজেদের শাসনতন্ত্র রচনা করবে।
  • (৪) সংবিধান সভার ব্রিটিশ ভারতের সদস্যগণ প্রাদেশিক আইনসভার নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত হবেন এবং দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা দেশীয় নৃপতিদের দ্বারা মনোনীত হবেন।
  • (৫) সংবিধান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ওপর ব্রিটিশের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকবে এবং ভারতীয়দের পূর্ণ সহযোগিতায় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সম্পদকে যুদ্ধকার্যে ব্যবহার করবে।

কংগ্রেসের ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব অস্বীকার

জাতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাব গ্রহণ করে নি। কারণ,

  • (১) এই প্রস্তাবে পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলা হয় নি যুদ্ধাবসানে ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ দেবার কথা বলা হয়েছিল মাত্র।
  • (২) প্রদেশগুলিকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার দান করার অর্থই হল পরোক্ষে জিন্নার দাবি মেনে নেওয়া।
  • (৩) ‘মনোনীত সদস্য’-রা সংবিধান সভায় আসতে পারবেন এই প্রস্তাবে কংগ্রেসের আপত্তি ছিল। দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিদের রাজারা মনোনীত করবেন, জাতীয় কংগ্রেস তা মানতে পারে নি।
  • (৪) ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভারতীয়দের কোনো অধিকার ছিল না।
  • (৫) এই প্রস্তাবে অন্তবর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠনেরও কোন কথা ছিল না। ভবিষ্যতে কি হবে তা নয় কংগ্রেস চেয়েছিল আশু ক্ষমতা লাভ।

ক্রিপস মিশন ব‍্যর্থতার কারণ :

একাধিক কারণে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়েছিল । ব্যর্থতার কারণগুলি নিম্নরূপ –

1. পূর্ণ স্বাধীনতার অভাব : এই প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের কোনো উল্লেখ ছিল না , আসলে ব্রিটিশ সরকার চায়নি ভারত স্বাধীনতা লাভ করুক । এটি ছিল লোক দেখানো কৌশল মাত্র।

2.সংবিধান সভাকেন্দ্রিক অভাব : এই প্রস্তাবে সংবিধান সভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগের কথা বলা হয়নি । ফলে ভারতীয়রা অসন্তুষ্ট হয়।

3. ভারত বিভাগের ইশারা : ক্রিপস মিশন কি ? ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব, ব‍্যর্থতার কারণ এবং ভারতে আসার প্রতিক্রিয়া | What is Cripps Mission এই প্রস্তাবে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটি কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের ইচ্ছা – অনিচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল । সেজন্য কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে । গান্ধিজি একে ‘ একটি ফেল পড়া ব্যাংকের অনুকূলে প্রদত্ত চেক ’ বলে নিন্দা করেছেন।

4. মুসলিম লিগের বিরোধ : ক্রিপসের প্রস্তাবে পৃথক পাকিস্তানের কথা বলা হয়নি । এর ফলে ভারতের মুসলিমরা হতাশ হয়ে পড়ে , মুসলিম লিগ ক্রিপসের প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যান করে।

5. ব্রিটিশ প্রশাসনের মধ্যে মতানৈক্য : ব্রিটিশ প্রশাসনের অনেকে ক্রিপসের বিরোধিতা করেছিলেন । তারা চাইতেন না যে ক্রিপস সফল হন । যেমন— চার্চিল , লিনলিথগো , ওয়াভেল প্রমুখ । তাঁদের বিরোধিতার জন্য ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়।

1942 খ্রিস্টাব্দের 11 এপ্রিল ক্রিপস একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন । ওই দিনের বেতারভাষণে তিনি কংগ্রেসকে এই ব্যর্থতার কারণে নানাভাবে দায়ী করেন । এপ্রিলের মাঝামাঝি ক্রিপস ইংল্যান্ডে ফিরে যান , পিছনে রেখে যান হতাশ ও ক্ষুব্ধ ভারতীয় জনগণকে । অধ্যাপক সুমিত সরকার লিখেছেন , ‘ অজস্র দ্বিমুখিতা আর ভুল বোঝাবুঝি ক্রিপস মিশনকে সর্বক্ষণ জর্জরিত করে আর শেষ অবধি ডুবিয়ে ছাড়ে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Under "Earnsite Batches," Tripura University Syllabus

3rd Semester Foundation Syllabus