নীল দর্পণ- দীনবন্ধু মিত্র

 নীল দর্পণ- দীনবন্ধু মিত্র

ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৩য় সেমিস্টার এর প্রথম একক হল নীলদর্পণ

নীল দর্পণ হল দীনবন্ধু মিত্র কতৃক ১৮৬০ খ্রি. রচিত একটি বাংলা সামাজিক নাটক। এই নাটকের পটভূমি নীল চাষের জন্য সাধারণ কৃষকদের উপর ইংরেজ শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়ন।

নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র:-

মাত্র ৪৪(চুয়াল্লিশ)বছরের জীবন সীমা। তা সত্ত্বেও কালজয়ী বাংলা সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্র । এক প্রতিবাদী কন্ঠ। ১২৩৬ সনের চৈত্র মাসে নদীয়া জেলার অন্তর্গত চৌবেড়িয়া গ্রামে জন্ম । প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ গ্রামের পাঠশালাতে । তারপর হেয়ার স্কুল । পরে হিন্দু কলেজ । ১৮৫৩সালে শিক্ষকতা কর্মের পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন । আনুমানিক ১৮৫৫ সালে পাটনায় পোষ্টমাষ্টার পদে যোগ দেন। পদোন্নতি হলে তিনি উড়িষ্যা বিভাগের ইনস্পেকটিং পোষ্টমাষ্টার হিসেবে নিযুক্ত হন । ডাক বিভাগের কাজে বিহার, বাংলা ও উড়িষার বহুস্থানে ঘুরতে হয়। লুসাই যুদ্ধের (১৮৭১) সময় তাঁকে কাছড়ে যেতে হয় । প্রচন্ড পরিশ্রমে তার স্বাস্থ্য ভেঙে যায় । চল্লিশ বছর বয়সের কিছু পরপর তিনি বহুমুত্র রোগে আক্রান্ত হন। ১৮৭৩ সালের ১লা নভেম্বর তাঁর জীবনাবসান হয়। 

তাঁর প্রথম নাটক ‘নীলদর্পণ' (১৮৬০)। এছাড়া তিনি বেশকিছু প্রহসন লেখেন তা হল - ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬), ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো' (১৮৬৬), ‘জামাই বারিক’ (১৮৭২), ‘নবীন তপস্বিনী’ (১৮৬৩), কমলে কামিনী' (১৮৭৩) প্রভৃতি।

নীলদর্পণ’ই তাঁর সবচাইতে জনপ্রিয় নাটক । নাটকটি ১৭৮২ শকাব্দের ২রা আশ্বিন, ইংরেজি ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় । ঢাকাতেই প্রথম অভিনীত হয়। পরেন্যাশানাল থিয়েটার ১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর এই নাটক দিয়ে তার দ্বারোদ্ঘাটন করে। ১৯০৮ সালে নাটকটি রাজদ্রোহীমূলক বলে অভিনয় বন্ধ করে দেওয়া হয় ।
**************************************

‘নীলদর্পণ’ এর পটভূমি:-

শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ নীলচাষের ক্ষেত্রে খুবই আদর্শ। ইংল্যান্ডে নীলের খুব চাহিদা থাকায় সাহেবরা এ দেশ নীলচাষ চালু করলেন । বাংলার কৃষকদের জোর করে দাদন নিতে বাধ্য করে নীলকরেরা নীলচাষ শুরু করেন। তাদের লাভের মাত্রাও এতে খুব বেড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের লোভও । এর ফলে চাষিদের চাষবাস বন্ধ করে দিয়ে কোথাও সামান্য টাকায় কোথাও বা কোন টাকা পয়সা না দিয়েই - জোর করে নীল বুনতে বাধ্য করল। কেউ যদি সামান্যতম বিরোধীতা করত, তা হলে তার ওপর দৈহিক অত্যাচার, অর্থদন্ড, বিনা বিচারে কুঠিতে আটক করে রাখত । পারিবারিক সম্মানহানি ও করত ।

দীনবন্ধু মিত্র কর্মসূত্রে নানান জায়গাব ঘুরে বেড়ান । তখন তিনি প্রজাদের এই দুরাবস্থা লক্ষ্য করেন। এরই ফল ‘নীলদর্পণ' নাটকটি শোনা যায় এর ইংরেজি অনুবাদ করেন মাইকেল মধূসূদন দত্ত এবং প্রকাশ করেন পাদরি জেমস্ লঙ । এই কারনে লঙ সাহেবের একমাস কারাদন্ড ও হাজার টাকা জরিমানার হয়। জরিমানার টাকা দিয়ে দেন কালীপ্রসন্ন সিংহ । আরো শোনা যায়, এইজন্য নাকি মধুসূদনকে সরকারী চাকরি ছাড়তে হয় ।

এদিকে ইংরেজের অত্যাচারের ফলে সাধারণ প্রজাদে মধ্যে বিক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়তে থাকে । রাজসরকারের তা মাথা ব্যাথার কারণ হয়। তখন সাহেবরা এই বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার জন্য জেলাগুলিকে বেশি সংখ্যক মহাকুমায় বিভক্ত করে আদালত নির্মাণ করে এবং আরো বেশি বেশি করে সৈন্য মোতায়েন করে । প্রজাদের বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের মোকদ্দমা দায়ের করে নীলকরেরা তাদের নিঃস্ব করে দেয়। শেষপর্যন্ত ১৮৬৮ সালে ‘নীলচুক্তি আইন' রদ করা হয়। আর ১৮৯২ সালে রাসায়নিক ভাবে নিল তৈরী করা গেলে নীলচাষ চিরতরে বন্ধ হয় । এক দুঃখয়, যন্ত্রণাময় ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে।
******************************

নীল দর্পণ- দীনবন্ধু মিত্র Link 

*****************************

***********************

নীলদর্পণ : ট্রাজেডি প্রসঙ্গ:-

কোমল ও রোমান্স কল্পনায় পূর্ণ বাঙালীর বস্তুতান্ত্রিক দার্শনিকতার সাথে পরিচয় উনিশ শতকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সংস্পর্শে । জীবনের লাভ লোকসান, সুখ-দুঃখ, প্রত্যাশা - হতাশা, সম্পর্কে বাঙালী সচেতন হল পাশ্চাত্যের সাহিত্যের ও দর্শনের বস্তুমুখীনতা ও জীবনমুখীনতার প্রভাবেই। এই পর্বেই বাঙালীর আত্মীয়তা গড়ে উঠল ‘ট্রাজেডি’ সাহিত্যের সঙ্গে । রঙ্গমঞ্চে এলেন শেক্সপীয়ার । কিন্তু পূর্ণতার আদর্শে বিশ্বাস ও জন্মান্তরীন কর্মফলের প্রত্যয় পূর্ণ সংস্কৃত নাটকে এই Art-form টি ছিল উপেক্ষিত, নিষিদ্ধ ও বলা যায় । কেননা আস্তিক্যবোধের সাথে ট্রাজেডি কল্পনার বিরোধ আছে ।

মধ্যযুগে ট্রাজেডির আদর্শ ছিল এমন - দুর্ভাগ্য হঠাৎ এসে মানুষকে বিপর্যস্ত করে তোলে । গ্রীক ট্রাজেডির আদর্শ অ্যারিস্টটল তাঁর “ই পোয়েটিকস্” গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে সংজ্ঞা নির্দেশ করেন -
"Tragedy is an imitation of an action that is
 serious, compleet and of an certain magnitude in 
language embellished with eah kind of artistic 
ornament, The several part of the play; in the form 
of action, not of narrative; through pity and fear
 effecting the proper purgation of these emotions."

প্রকৃত ট্রাজেডির (Tragedy) তত্ত্ব হচ্ছে :-

১। একজন সর্বগুণ সম্পন্ন দেবদুর্লভ নরোত্তমের বিষাদান্ত কাহিনীৱ, যার অক্ষম লড়াই নেমেসিস বা নিয়তির সাথে যিনি নিয়তির আঘাতে পর্যুদস্ত হবে কিন্তু হার মানবে না ।
২। নায়কের ভয়াবহ পরিণতি দর্শক ও পাঠকের মনে করুণা ও ভয়ের (Pity and fear) সৃষ্টি করে।
৩ । ট্রাজেডির পাত্রপাত্রীদের সংলাপ হবে সংগীত বহুল উচ্চাঙ্গ কাব্যগুন সমন্বিত 
        (High poetry of melody)
৪ । কাহিনী এগোবে সংলাপের মধ্য দিয়ে।
৫। পাঠক মনে ঘটবে ভাবমোক্ষণ (Catharsis) নীলদর্পণে ট্রাজেডি সৃষ্টির উপকরণ আছে । সাধারণ ভাবে নীলকরদের অত্যাচার বর্ণিত হলেও তাদের উৎপীড়নে ও প্রতিহিংসা দীপ্ত ক্রোধে বিপর্যস্ত হয়েছে দুটি পরিবার । সাধুচরণের পরিবার ধর্ষিতা ক্ষেত্রমণির গর্ভপাত হেতু মৃত্যু এবং গোলক বসুর মিথ্যে হাজত বাসের লজ্জা থেকে আত্মহত্যা, নবীনমাধবের মর্মান্তিক জীবনাবসান,ক্ষিপ্তা জননীর সন্দেহ বশে পুত্রবধুর জীবন হানি ও প্রকৃতিস্থ হয়ে অনুশোচনায় তাঁর মৃত্যুই - এ সকল অপরিমিত শোচনীয় অপচয়ের কাহিনী - উদ্ঘাটিত হয়েছে।

দুটিপরিবারের এই যে শোকাবহ পরিণামতা নিয়ে উৎকৃষ্ট ট্রাজেডি নাটক রচনা করার অবকাশ ছিল ।

কিন্তু নীলদর্পণ সার্থক ট্রাজেডি হতে পারেনি । কেন না বংশ পরম্পরাগত কোন পাপ বা কোন চারিত্রিক দুর্বলতা বা ত্রুটির জন্য এখানে ট্রাজেডি আসে নি । এখানে মানুষের থেকেই এসেছে মানুষের যাবতীয় অত্যাচার, লাঞ্ছনা । গ্রীক ট্রাজেডির আদর্শ বা শেক্সপীয়রের রীতি অনুসৃত নয় । শেক্সপীয়রের নাটকে

ট্রাজেডির বীজ নায়ক চরিত্রে নিহিত । তাঁর চরিত্রের ত্রুটির রন্ধ্রপথে দুর্ভাগ্যের শনিপ্রবেশ করে । এই বিপর্যয় এত আকস্মিক ও গভীর যে তা দর্শক মনে নায়ক সম্বন্ধে প্রীতি ও শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে ।
এখানে অত্যাচারিত দুর্গত মানুষের প্রতিরোধের অসম সংঘর্ষের ক্ষেত্র রচিত হয়েছে। উভয় পক্ষ শক্তি সামর্থে সমান হওয়ায় দ্বন্দ্ব তীব্র হয় নি। সংঘর্ষ যত তীব্র হয় আশা - নিরাশায় দোদুল্যমান পাঠক মনে ততই প্রতীক্ষরস ঘনীভূত হয়, - নাট্যপরিনাম জানতে উৎসাহী হয়ে ওঠে । কিন্তু এখানে অসম সংঘাত চিত্তকেউৎকণ্ঠিত, আবেগ মথিত না করে নিরুপায় নরনারীর করুণ পরিণাম মনকে ভীতি বিহ্বল রাখে । স্বভাবত এখানে করূনরস প্রাধান্য পেয়েছে কিন্তু তা ট্রাজিক রসকে ঘনীভূত করে নি । বাস্তব জীবনে যা ঘটে তা নিয়ে নাটক সৃষ্টি হয় না । যা সম্ভাব্য ঘটনার প্রবাসে যা অনিবার্য ; তা নিয়ে নাটক রসসিদ্ধ পরিনামী হয়। অ্যারিস্টটল একে বলেন - What is possible as being probable or necessary.”
**********************************************************************************

মন্তব্যসমূহ

  1. এটি এখনো সম্পন্ন হয়নি
    আরেকটু সময় লাগবে

    উত্তরমুছুন
  2. নীল দর্পণ নাটকে ক্ষেত্র মুনির চরিত্র নিয়ে আলোচনা করো ?
    এই Question ar Answer ta dao.

    উত্তরমুছুন
  3. Dada নীল দর্পণ নাটক থেকে 2-Mark এর দাওনা Plz

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Cripps mission

Under "Earnsite Batches," Tripura University Syllabus

3rd Semester Foundation Syllabus